ত্রিফলার উপকারীতা জানেন তো?
সেই প্রাচীন কাল থেকে আমাদের শরীরকে সুস্থ্য রাখার জন্য ত্রিফলা খাওয়া হয়ে আসছে। প্রাচীন অনেক শাস্ত্রে ত্রিফলার কথা উল্লেখ করা আছে। শুধু প্রাচীন শাস্ত্রেই নয়, বর্তমান বিজ্ঞানেও ত্রিফলার গুনের কথা প্রমাণিত হয়েছে। আসলে ত্রিফলা হলো তিনটি ফলের মিশ্রণ । ফলগুলো হলো হরীতকি, আমলকি এবং বহেড়া।এই তিনটি ফলের বীজ বাদে বাকি অংশ শুকিয়ে গুঁড়ো করে সমপরিমাণে মিশিয়ে ত্রিফলা তৈরি করা হয়।
উপাদান এবং পুষ্টিমানঃ
আসলে ত্রিফলা হলো হরীতকি, আমলকি এবং বহেড়ার মিশ্রণ। এই মিশ্রণ তৈরি করার জন্য প্রথমে ফল সংগ্রহ করে শুকাতে হবে। তার পর বীজ বাদে ফলের বাকি অংশ সমান অনুপাতে মিশিয়ে গুঁড়া করতে হবে। তারপর এই গুঁড়া চেলে মিহি গুঁড়ার মিশ্রণ ত্রিফলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
হরীতকি তিতা স্বাদযুক্ত একটি ফল যা আমাদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। তাই মস্তিষ্ক ও স্নায়ুবিক যেকোনো রোগে হরীতকি খুবই কার্যকর। হরীতকি রেচন, সঙ্কোচক, পিচ্ছিলকারক, পরজীবীনাশক, মাংসপেশির সঙ্কোচক প্রতিরোধক এবং স্নায়ুবিক দুর্বলতা প্রতিরোধী গুণসম্পন্ন একটি ফল।
আমলকি অম্ল বা টক স্বাদযুক্ত যা ঠাণ্ডাকারক, সঙ্কোচক গুণসম্পন্ন একটি ফল। যা আমাদের বিপাক (Metabolism) জনিত বিভিন্ন সমস্যা যেমন- আলসার, পাকস'লীর প্রদাহ, আন্ত্রিক প্রদাহ, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, লিভারের জ্বালাপোড়া, লিভার সংক্রামণ (Liver Infection) এবং শরীরের জ্বালাপোড়া নিরাময়ে আমলকি খুবই কার্যকর। আধুনিক অসংখ্য গবেষণায় আমলকির ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস প্রতিরোধী, কফ নিঃসারক এবং হৃৎপিণ্ডের টনিক গুণাবলির প্রমাণ পাওয়া যায়। আমলকিতে আছে ভিটামিন-সি এবং অতি উচ্চ তাপেও এর ভিটামিন-সি নষ্ট হয় না। তাই আমলকির পুষ্টি ও ঔষধিগুণ অপরিবর্তিত রেখে শুকিয়ে এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। আমলকীর ভিটামিন-সি দীর্ঘস্থায়ী ও তাপ সহ্যকারী হওয়ার মূল কারণ এতে থাকা ট্যানিন ভিটামিন-সির সাথে বন্ধন তৈরি করে এবং এর ক্রমাগত হ্রাস বা ধ্বংস হওয়া প্রতিরোধ করে।
বহেড়া একটু কষা স্বাদ যুক্ত ফল। এটি সঙ্কোচক টনিক, হজমশক্তির বৃদ্ধিকারক এবং মাংসপেশির সঙ্কোচন (Spasm) প্রতিরোধক গুণসম্পন্ন। বহেড়া দেহের প্রধান জীবনীশক্তি শ্লেষ্মা তথা হরমোনকে বিশুদ্ধ করে এবং এর ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই বহেড়া হাঁপানি, অ্যালার্জি, ব্রঙ্কাইটিস ও কাশির ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর।
উপকারীতাঃ
১। ত্রিফলার অন্যতম একটি গুণ হলো এটি আমাদের লিভার পরিষ্কারের পাশাপাশি লিভার থেকে পিত্ত নিঃসরণ বাড়ায় এবং অন্ত্র ও পৌষ্টিক নালীর স্বাভাবিক সঙ্কোচন প্রসারণ নিয়ন্ত্রণ করে। পিত্ত রস আমাদের হজম প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে এবং আমাদের মলকে নরম হতে সহায়তা করে। এটি শুধু হজমশক্তি বৃদ্ধি করে না বরং খাদ্যের উপাদানগুলোর শোষণেও সহায়তা করে।এটি পাকস্থলীর অম্লীয় (Acidic) ও ক্ষারীয় (Alkaline) অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে হজমশক্তি বৃদ্ধি করে এবং সঠিক হজমক্রিয়া পরিচালনা করে।ফলে আমাদের হজম শক্তি বাড়ে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়।
২। এটি আমাদের শ্বাসনালী থেকে শ্লেষ্মা বা কফ নিঃসরণ করে এবং আমাদের শ্বাসনালীর কর্মক্ষমতা স্বাভাবিক রাখে। এটি আমাদের দেহে ও শ্বাসনালীতে অ্যালার্জির প্রকোপ কমায়। ফলে অ্যাজমা রোগে এটি খুবই উপকারী ভূমিকা পালন করে। এটি আমাদের সাইনাস থেকে শ্লেষ্মা বের করে দেয়, ফলে সাইনোসাইটিসজনিত মাথাব্যথা কমে যায়।
৩। ত্রিফলা আমাদের চামড়া এবং ত্বকের স্বাভাবিক গঠন নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষা করতে পারে। ত্রিফলা দেহে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়। এর ফলে ামাদের ত্বক পরিপূর্ণ পুষ্টি পায়। অপর দিকে বেশি রক্ত সঞ্চালন হওয়ায় ত্বকে জমে থাকা মৃত কোষগুলোর অপসারি হয়। ত্রিফলা বয়সের ফলে চামড়ার ভাঁজ ও চুল সাদা হয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করে। ত্রিফলা দেহে রক্ত ও পানির সুসামঞ্জস্য রক্ষা করে।ফলে আমাদের ত্বক উজ্জ্বল ও আর্দ্র থাকে এবং বয়সের ছাপ পড়ে না।
৪। ত্রিফলা আমাদের রেচনতন্ত্রের বা কিডনির কাজে সহায়তা করে। ফলে আমাদের বিভিন্ন অন্ত্র পরিমাণমতো পানির সরবরাহ পায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময় হয়। অপর দিকে এটি মূত্র সংবহনতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। অন্ত্র, মূত্র সংবহনতন্ত্র ও রেচন তন্ত্রের ভারসাম্যপূর্ণ স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য আমাদের দেহ শীতল থাকে এবং উচ্চ তাপমাত্রায় হিট স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি কমে।
৫। ত্রিফলা আমাদের প্রজননতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে খুবই উপকারী। এটি প্রজনন অঙ্গগুলোর pH লেভেল নিয়ন্ত্রণ করে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের প্রজনন অঙ্গকে শক্তিশালী করে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ত্রিফলা পুরুষের শুক্রাণু বৃদ্ধি করে এবং মহিলাদের মাসিক চক্র নিয়মিত করে। তাই প্রজননতন্ত্রের সমস্যায় ত্রিফলা খুবই উপকারী।
সাবধানতাঃ
ত্রিফলা গুঁড়ার কার্যকারিতা দুই মাস পর থেকে কমতে শুরু করে। তাই দুই মাসের অধিক সময়ের বেশি পুরোনো ত্রিফলার গুঁড়া সেবন না করাই ভালো।